তালাক ইসলামী শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ভঙ্গ করার জন্য প্রযোজ্য। এটি ইসলামী শরীয়তের আওতায় পরিচালিত একটি বৈধ কার্যক্রম। বিবাহ যেমন দুটি মানুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের একটি পবিত্র চুক্তি, ঠিক তেমনি ডিভোর্স সেই সম্পর্ক ভঙ্গ করার একটি নির্ধারিত প্রক্রিয়া। ইসলামে তালাককে অত্যন্ত জরুরি ও শেষ উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এটি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধ কাজগুলোর একটি।
তালাকের সঠিক নিয়ম ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার ফলে অনেকেই ভুল পথে তালাক দেন, যা পরবর্তীতে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে। ইসলামে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নির্ধারিত নিয়ম-কানুন ও প্রক্রিয়া খুবই স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম প্রধান দেশে ডিভোর্স দেওয়ার আইনি, সামাজিক এবং ধর্মীয় দিকগুলো জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই নিবন্ধে তালাকের সংজ্ঞা, শর্ত, প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন বিধান বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে পাঠকরা এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করতে পারেন।
তালাক কী?
তালাক শব্দের অর্থ হলো মুক্তি বা বিচ্ছেদ। ইসলামিক শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। তালাক তিন প্রকার হতে পারে:
- তালাক-এ-রাজী: পুনরায় বিবাহের সুযোগ রেখে তালাক।
- তালাক-এ-বায়েন: পুনরায় বিবাহ ছাড়া পুনর্মিলনের সুযোগ নেই।
- তালাক-এ-মুঘাল্লাজা: চূড়ান্ত তালাক, যেখানে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনের কোনো সুযোগ নেই।
তালাকের শর্ত কি কি?
তালাক কার্যকর করার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলো হলো:
- স্বামী পূর্ণবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে।
- তালাক দিতে ইচ্ছুক হতে হবে, কোনো প্রকার চাপ বা বাধ্যবাধকতা থাকলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
- তালাক ঘোষণা স্পষ্ট ভাষায় বা লিখিতভাবে হতে হবে।
- স্ত্রীকে পবিত্র অবস্থায় থাকতে হবে (হায়েজ-মুক্ত)।
তালাকের সঠিক নিয়ম কি?
তালাকের সঠিক নিয়মগুলো হলো:
- পবিত্র অবস্থায় ডিভোর্স প্রদান।
- সালিশি প্রক্রিয়ার অনুসরণ।
- আইনগত নিয়ম মেনে রেজিস্ট্রেশন।
তালাক কি মুখে উচ্চারণ করতে হয়?
ইসলামী শরীয়তে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর করার জন্য মুখে উচ্চারণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এটি একটি সরাসরি এবং সুস্পষ্ট প্রক্রিয়া, যা শারীরিক, মৌখিক বা লিখিতভাবে সম্পন্ন হতে পারে। তবে মুখে উচ্চারণ করা তালাকের সবচেয়ে প্রচলিত এবং সরাসরি পদ্ধতি। তাই তালাকের ঘোষণা করার আগে সবদিক ভালোভাবে বিবেচনা করা উচিত।
কি কি শব্দ বললে তালাক হয়?
ডিভোর্স কার্যকর করার জন্য সুনির্দিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করা প্রয়োজন। উদাহরণ:
- “তোমাকে তালাক দিলাম।”
- “আমাদের সম্পর্ক শেষ করলাম।”
কি কি কারণে তালাক হয়?
তালাকের কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য।
- আর্থিক সংকট।
- বিশ্বাসঘাতকতা।
- পারিবারিক চাপে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া।
কি কি কারণে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া যায়?
স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার কিছু সাধারণ কারণ হলো:
- চরিত্রগত সমস্যা।
- দাম্পত্য কলহ।
- বিশ্বাসের অভাব।
তালাক কিভাবে কার্যকর হয়?
তালাক কার্যকর হওয়ার ধাপ:
- ডিভোর্স ঘোষণা করা।
- নোটিশ প্রেরণ।
- সালিশি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।
- রেজিস্ট্রেশন।
ডিভোর্সের জন্য কি কি লাগে?
ডিভোর্স করার জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র:
- বৈবাহিক সনদ।
- জাতীয় পরিচয়পত্র।
- তালাক নোটিশ।
- সালিশি চুক্তিপত্র।
ডিভোর্স দিতে কত টাকা লাগে?
বাংলাদেশে ডিভোর্স প্রক্রিয়ার জন্য নির্ধারিত ফি নির্ভর করে এলাকাভেদে:
- তালাক নোটিশের ফি।
- রেজিস্ট্রেশন ফি।
- আইনজীবীর খরচ।
মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রীকরণ) যে আইনগুলো জানা প্রয়োজন
মুসলিম বিবাহ ও ডিভোর্স রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো:
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১, পাকিস্তান আমলে প্রণীত একটি আইন, যা এখনো বাংলাদেশে কার্যকর। এই আইনে মুসলিম বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণ-পোষণ এবং উত্তরাধিকারের বিষয়ে নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। এটি দাম্পত্য সম্পর্কের সমাধান এবং পরিবারের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনে তালাক দেওয়ার জন্য স্বামীকে লিখিত নোটিশ দেওয়া এবং স্থানীয় সালিশি কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি পরিচালনার বিধান রয়েছে।
বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইন, ১৯৭৪
এই আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলিম বিবাহ ও তালাককে নথিভুক্ত করা। আইনের আওতায় প্রতিটি বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশনের জন্য অনুমোদিত কাজী নিযুক্ত রয়েছেন। ডিভোর্স কার্যকর করতে কাজীর মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই আইন বিবাহ এবং তালাকের প্রমাণ সংরক্ষণে সহায়ক, যা ভবিষ্যতে কোনো আইনি সমস্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তালাক কার্যকর করতে সালিশি কাউন্সিলের ভূমিকা
তালাক কার্যকর করতে সালিশি কাউন্সিলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহ বিচ্ছেদ নোটিশ পাওয়ার পর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ সালিশি কাউন্সিল গঠন করেন। এই কাউন্সিল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতবিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করে। যদি সালিশি প্রক্রিয়ায় সমঝোতা না হয়, তাহলে নির্ধারিত সময় পরে তালাক কার্যকর হয়। এটি একটি সমঝোতামূলক পদ্ধতি, যা দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টার অংশ।
স্বামী স্ত্রীকে কিভাবে তালাক দিবে?
স্বামী স্ত্রীর প্রতি ডিভোর্স প্রদান করতে হলে তাকে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হয়:
- স্ত্রীকে সরাসরি মৌখিক বা লিখিত তালাক প্রদান।
- ডিভোর্স নোটিশ প্রেরণ।
- তালাক কার্যকর হওয়ার জন্য সালিশি কাউন্সিলের অনুমোদন।
বাংলাদেশে কিভাবে স্ত্রীকে তালাক নোটিশ পাঠাতে হয়?
বাংলাদেশে মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইনের অধীনে বিবাহ বিচ্ছেদ নোটিশ পাঠানোর প্রক্রিয়া খুবই নির্দিষ্ট:
- তালাক নোটিশ লিখিত আকারে প্রস্তুত করুন। এক্ষেত্রে এখান থেকে তালাক নামা ফরম ডাউনলোড করুন
- স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিন।
- এক কপি ডিভোর্স নোটিশ স্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়।
- নোটিশ জমা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিশি সভার ব্যবস্থা করা হয়।
স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম
স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে তালাক দিতে হলে “খুলা” প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এখানে স্ত্রীর সম্মতির ভিত্তিতে স্বামী স্ত্রীকে ডিভোর্স প্রদান করেন। তবে এটি কার্যকর করতে কিছু শর্ত মানতে হয়:
- স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে মুক্তি চাইতে পারে।
- উভয়ের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এক্ষেত্রে এখান থেকে স্ত্রী কর্তৃক তালাকের নোটিশ ফরম পাঠানো যেতে পারে।
কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম
কোর্টের মাধ্যমে ডিভোর্স দেওয়া একটি আইনগত প্রক্রিয়া:
- মামলা দায়ের করুন।
- উভয় পক্ষের শুনানি।
- কোর্টের চূড়ান্ত রায়।
- রায় কার্যকর করার জন্য রেজিস্ট্রেশন।
ইসলামে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দেওয়ার নিয়ম
ইসলামে স্ত্রীও স্বামীকে তালাক দিতে পারে। এটি “খুলা” নামে পরিচিত। এর জন্য স্ত্রীর পক্ষ থেকে কিছু নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
খুলা তালাকের নিয়ম
খুলা তালাকের নিয়মগুলো হলো:
- স্ত্রীর আবেদন: স্ত্রী যদি বৈবাহিক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে না চান, তবে তিনি স্বামীর কাছে খুলার আবেদন করতে পারেন। এতে তিনি স্পষ্ট করে বিচ্ছেদের কারণ উল্লেখ করবেন।
- স্বামীর সম্মতি: খুলা কার্যকর করতে স্বামীর সম্মতি আবশ্যক। এটি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে একটি পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়।
- দেনমোহর ফেরত: সাধারণত স্ত্রী খুলা চাইলে দেনমোহরের সম্পূর্ণ বা আংশিক অংশ ফেরত দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে এটি স্বামীর ওপর নির্ভরশীল।
- সালিশি প্রক্রিয়া: যদি স্বামী খুলায় সম্মতি না দেন, তবে স্ত্রীর পক্ষ থেকে সালিশি কাউন্সিল বা আদালতে আবেদন করা যায়। স্থানীয় সালিশি পরিষদ বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করে।
- কোর্টের মাধ্যমে খুলা: স্বামী যদি কোনোভাবেই ডিভোর্স দিতে রাজি না হন, তবে স্ত্রী কোর্টে মামলা করতে পারেন। আদালত বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চূড়ান্ত রায় প্রদান করবে।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
খুলা নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নিচে আলোচনা করা হলো:
১. কুরআনের নির্দেশনা:
“যদি স্ত্রী-স্বামী একে অপরকে মেনে চলতে অসমর্থ হয় এবং সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব না হয়, তবে স্ত্রী কিছু ফিরিয়ে দিয়ে বিচ্ছেদ নিতে পারে।” সুরা আল-বাকারা (২:২২৯)
২. হাদিসের নির্দেশনা:
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, এক নারী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে খুলার জন্য আবেদন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার স্বামীকে দেনমোহর ফিরিয়ে নেওয়ার শর্তে তালাক দিতে নির্দেশ দেন। (বুখারি: ৫২৭৩)
খুলার কারণগুলো
স্ত্রী নিচের কারণে খুলার আবেদন করতে পারেন:
- স্বামীর সঙ্গে মানসিক বা শারীরিকভাবে সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব না হলে।
- স্বামী স্ত্রীর অধিকার যথাযথভাবে পালন না করলে।
- স্বামী কোনো গুরুতর অপরাধে লিপ্ত হলে।
- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর মতবিরোধ বা অবিশ্বাস দেখা দিলে।
ইগলাক বা রাগান্বিত ব্যক্তির তালাক এর বিধান
ইগলাক বলতে বোঝানো হয় এমন মানসিক অবস্থা, যখন ব্যক্তি রাগ, বিষণ্ণতা বা চাপের কারণে নিজের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
ইসলামী শরীয়তে রাগের মুহূর্তে ডিভোর্স দিলে সেটি কার্যকর হয় কিনা, তা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। যদি রাগ খুব বেশি হয় এবং মনের স্বাভাবিক অবস্থা না থাকে, তবে তালাক কার্যকর নাও হতে পারে।

ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী, রাগান্বিত পরিস্থিতিতে প্রদত্ত তালাক কার্যকর হয় কিনা, তা নির্ধারণের জন্য বিশেষ বিধান রয়েছে। কুরআন এবং হাদিসে এই বিষয়ে কিছু নির্দেশনা পাওয়া যায়।
কুরআনের নির্দেশনা
“তোমার প্রভুর পথে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে আহ্বান জানাও এবং তাদের সাথে সুন্দরতম পদ্ধতিতে বিতর্ক করো।” (সুরা আন-নাহল: ১২৫)
এই আয়াত রাগ বা উত্তেজনার মুহূর্তে সংযম প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত করে, যা বিবাহ বিচ্ছেদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আবশ্যক।
“তোমরা যদি স্ত্রীদের তালাক দিতে চাও, তবে তা তাদের ইদ্দতকালে করো এবং ইদ্দতের সময় গণনা করো।” (সুরা আল-বাকারা: ২২৬-২৩২)
এই আয়াত বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়। রাগান্বিত অবস্থায় তালাক দিলে যদি প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ না হয়, তবে তা বাতিল হতে পারে।
হাদিসের নির্দেশনা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তিনটি বিষয়ে সিরিয়াস হওয়া এবং রসিকতা উভয়ই কার্যকর: বিবাহ, তালাক এবং ফিরিয়ে নেওয়া।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২০৪৩)
এই হাদিসে বিবাহ বিচ্ছেদের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। তবে রাগান্বিত অবস্থায় এটি কার্যকর হতে পারে কি না, তা নির্ভর করে সেই সময়ে ব্যক্তির মানসিক অবস্থার উপর।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তিন ধরনের ব্যক্তি আছে যাদের কাজ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়: ঘুমন্ত ব্যক্তি, পাগল এবং শিশু।” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২১৯৩)
রাগের চরম মুহূর্তে যদি ব্যক্তি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং স্বাভাবিক বিচারক্ষমতা হারায়, তবে ডিভোর্স কার্যকর হবে না। এটি “ইগলাক” পরিস্থিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রাগ শয়তানের কাজ।” (সাহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৭৮)
তাই রাগান্বিত অবস্থায় দেওয়া ডিভোর্স সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। রাগ প্রশমিত হওয়ার পরই তালাকের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
ইসলামী পণ্ডিতদের মতামত
বেশিরভাগ ইসলামিক স্কলাররা বলেন, যদি রাগের কারণে ব্যক্তি এমন অবস্থায় পৌঁছে যেখানে তিনি নিজের কথা ও কাজের জন্য দায়ী নন, তবে সেই অবস্থায় দেওয়া তালাক কার্যকর হবে না। তবে রাগ যদি স্বাভাবিক হয় এবং ব্যক্তি তার কথা ও কাজ সম্পর্কে সচেতন থাকে, তবে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হবে।
তিন তালাকের পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার বিধান
ইসলামে তিন তালাক হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে স্বামী একসঙ্গে বা বিভিন্ন সময়ে স্ত্রীকে তিনবার তালাক প্রদান করেন। তিন তালাকের পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এবং এই অবস্থায় স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ নিয়ম রয়েছে। নিচে এই বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
তিন তালাকের প্রভাব
তিন তালাক একবারে বা পৃথকভাবে দেওয়া হলে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তালাক-এ-মুগাল্লাজা (চূড়ান্ত তালাক) হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য হারাম হয়ে যান। এই অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিশেষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার নিয়ম
১. হালালা বৈধতা: তিন তালাকের পরে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে হলে, তিনি প্রথমে অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে বৈধভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।
- নতুন স্বামীর সঙ্গে সংসার চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
- যদি নতুন বিবাহ কোনো কারণে ভেঙে যায় (যেমন ডিভোর্স বা স্বামীর মৃত্যু), তবে ইদ্দত শেষে তিনি আগের স্বামীর সঙ্গে পুনরায় বিবাহ করতে পারবেন।
- এটি হালালা নামে পরিচিত।
২. হালালা জোরপূর্বক নয়: ইসলামে হালালা করার জন্য ইচ্ছাকৃত বা পরিকল্পিত কোনো চেষ্টা নিষিদ্ধ। এটি রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক কঠোরভাবে নিন্দিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য হালালার উদ্দেশ্যে বিবাহ করে, তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ।” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২০৭৬)
৩. নতুন বিবাহ বৈধ হতে হবে:
- নতুন বিবাহটি প্রকৃতপক্ষে বৈধ হতে হবে।
- নতুন স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
- এটি শুধু সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের একটি শর্ত, জোর করে বা কৌশলে এটি করা ইসলামসম্মত নয়।
তালাক সম্পর্কে কুরআন কি বলে?
কুরআন মজিদে তালাকের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে। ডিভোর্স একটি বৈধ প্রক্রিয়া হলেও এটি শেষ অবলম্বন হিসেবে বিবেচিত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কের টানাপোড়েন মীমাংসার জন্য ইসলাম বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়ম-কানুন এবং সময়সীমা নির্ধারণ করেছে।
কুরআনে আছে,
“তালাক দুইবার পর্যন্ত বৈধ। তারপর সম্পর্ক পুনরুদ্ধার বা বিচ্ছেদ চূড়ান্ত কর।” (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৯-২৩১)
এই আয়াতে বলা হয়েছে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বৈধ নয়। তালাক ধীরে ধীরে এবং নিয়ম মেনে দিতে হবে।
“হে নবী! যখন তোমরা নারীদের তালাক দেবে, তখন তাদের ইদ্দতের জন্য তালাক দাও এবং ইদ্দত গণনা কর। তোমরা তাদের ইদ্দতের সময়ে ঘর থেকে বের করে দিও না এবং তারাও যেন বের না হয়।” (সুরা আত-তালাক, আয়াত: ১)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, ডিভোর্স দেওয়ার জন্য স্ত্রীকে পবিত্র অবস্থায় থাকতে হবে, এবং ইদ্দত পালনের সময় তাদের স্বামীর ঘরেই থাকা উচিত।
“যদি তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, তবে উভয়ের পরিবার থেকে একজন সালিশি নিয়োগ কর। যদি তারা সমঝোতা চায়, তবে আল্লাহ তাদের মধ্যে মিলিয়ে দেবেন।” (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৫)
ডিভোর্স দেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক সালিশি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তালাক সম্পর্কে নবীজী কি বলেছেন?
তালাক সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তালাক আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধ কাজ।” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২১৭৮)
তিনি দাম্পত্য কলহ মিটিয়ে ফেলার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
তালাকের নিয়ম সম্পর্কিত ৬টি সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
তিন তালাক দেওয়া কি বৈধ?
একবারে তিন তালাক দেওয়া ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী নিয়মবহির্ভুত এবং এটি রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্বারা নিন্দিত। তিন তালাক দেওয়া হলে স্ত্রী স্বামীর জন্য হারাম হয়ে যান এবং হালালা ছাড়া পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব নয়।
ইদ্দত কী এবং এটি কতদিন পালন করতে হয়?
ইদ্দত হলো তালাক বা স্বামীর মৃত্যু পরবর্তী একটি নির্দিষ্ট সময়, যখন স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে না। তালাকের পর ইদ্দতকাল: তিন মাসিক চক্র ; স্বামীর মৃত্যু হলে: চার মাস দশ দিন।
তালাক কখন কার্যকর হয় না?
তালাক তখন কার্যকর হয় না, যখন সেটি মনে মনে দেওয়া হয়, রাগান্বিত অবস্থায় দেওয়া হয়, বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেওয়া হয়। স্ত্রী মাসিক অবস্থায় থাকলে, বা শর্তসাপেক্ষ তালাকের শর্ত পূরণ না হলে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হবে না। এছাড়াও, দ্ব্যর্থবোধক বা অস্পষ্ট ভাষায় ডিভোর্স দিলে তা কার্যকর হয় না।
বাংলাদেশে আইনি প্রক্রিয়ায় ডিভোর্স নিবন্ধন না করলে সেটি কার্যকর হয় না। তালাক কার্যকর করার জন্য সুস্পষ্ট ভাষা, সচেতন মন, এবং ইসলামী শরীয়তের নিয়ম মেনে চলা অপরিহার্য।
সাক্ষী ছাড়া কি তালাক হয়?
তালাক সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ বিরোধ এড়াতে সাক্ষী রাখা উত্তম। সাক্ষী ছাড়া তালাক দেওয়া ইসলামী শরীয়তের মূলনীতিতে বৈধ হলেও এটি নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষ।
৩ তালাকের কতদিন পর মিলন করা যায়?
ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী, তিন তালাক দেওয়ার পরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে তারা আর একে অপরের জন্য বৈধ থাকে না। তাই তিন তালাকের পরে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জোরপূর্বক কোনো সম্পর্ক স্থাপন ইসলামে নিষিদ্ধ।
ভয় দেখানোর জন্য তালাক বললে কি তালাক হবে?
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হওয়ার জন্য স্বামীর ইচ্ছাকৃত এবং স্পষ্ট সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। ভয় দেখানোর জন্য তালাক বললে, যদি তা স্বামীর প্রকৃত ইচ্ছার বাইরে হয়, তবে এটি তালাক হিসেবে কার্যকর হবে না। তবে এমন পরিস্থিতিতে ইসলামী বিশেষজ্ঞ বা আলেমের সঙ্গে পরামর্শ করে বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত।
উপসংহার
তালাক একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। এটি আইনগত, সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়ম ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে আরোও বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করুন বিশেষজ্ঞদের সাথে।
- Register Marriage Procedure for Lovers in Bangladesh - February 23, 2025
- A Detailed Guide About Marriage Registrar in Bangladesh | Learn About Their Role, Process, Fess, And So On - February 22, 2025
- তালাকের নিয়ম কি? ইসলামি শরিয়া এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুসারে একটি পরিপূর্ণ গাইড - January 24, 2025